MrJazsohanisharma

ঘেটুপুত্র কমলা সিনেমা, গেলমানের কাহিনি ও আফগানে 'বাচা বাজি'

ঘেটুপুত্র কমলা সিনেমা

ঘেটুপুত্র কমলা (প্লেজার বয় কমলা) হল ২০১২ সালের একটি বাংলাদেশী মিউজিক্যাল ফিল্ম- যা হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত। ছবিটি মৃত্যুর আগে হুমায়ূন আহমেদের শেষ ছবি। ছবিটি ৮৫ তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা বিদেশী ভাষার অস্কারের জন্য বাংলাদেশী এন্ট্রি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল, কিন্তু এটি চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করতে পারেনি। 

পটভূমি 

গল্পটি ১৫০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে। ঔপনিবেশিক যুগে হবিবগঞ্জের জলশুকা গ্রামের সত্য ঘটনা। সেই সময়ে ঘেটুগান নামে একটি বাদ্যযন্ত্রের দল তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে অল্পবয়সী ছেলেরা মেয়েদের পোশাকে নাচত; সেই নর্তকীদের বলা হত 'ঘেটু'। শীঘ্রই তারা মানুষের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে, কিন্তু প্রভাবশালীর যৌন আকাঙ্ক্ষার জন্য তাদের চেয়েছিল, এবং ধীরে ধীরে সমসাময়িক স্থানীয় সমাজে অভিজাত পেশা স্বীকৃত হয়ে ওঠে। বন্যার মৌসুমে ঘেটুরা ভাড়া পেত। গল্পটি একটি কিশোর বালককে নিয়ে- যাকে ঔপনিবেশিক যুগের একজন জমিদার তার যৌন আকাঙ্ক্ষাকে বিনোদন দেওয়ার জন্য বার্ষিক বন্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভাড়া করে। মুভিটি শুরু হয় একটি অল্প বয়স্ক ছেলে এবং তার পরিবারের সাথে, যারা বন্যার সময় কাজ করতে পারে না বলে কাজ খুঁজছে। ছোট ছেলে এবং তার বাবা একটি মিউজিক্যাল গ্রুপে যোগ দেয়, যেখানে ছেলেটি (কমলা) ঘেটু হিসাবে কাজ করে।

প্রথম নাচের পারফরম্যান্সের পর সম্ভ্রান্ত এক প্রভাবশালী যুবককে যৌন হেনস্থা করে। এই প্যাটার্ন পুরো সময় জুড়ে পুনরাবৃত্তি করে যে বাদ্যযন্ত্র দল সেখানে থাকে।  কমলার প্রতি তার ক্রমবর্ধমান আবেশ লক্ষ্য করে জনৈক্যের স্ত্রী নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। নাচের পারফরমেন্সের জন্য ভাড়া করা বাড়িওয়ালা বন্যা শেষ হওয়ার পরেও কমলাকে রাখার পরামর্শ দেন- যা তার স্ত্রীকে বিরক্ত করে। তিনি গোপনে তার কাজের মেয়েকে নির্দেশ দেন কমলাকে বারান্দার রেলিং থেকে ধাক্কা দিতে- যেখানে সে সাধারণত চোখ বন্ধ করে হাঁটতে পছন্দ করে। দাসী, একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরে, ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং সে মারা যায়।

গেলমানের কাহিনি

প্রাচীনকালের বিভিন্ন সাহিত্যে যেভাবে বিলাসী জীবনযাপনের অংশ হিসেবে হেরেমভর্তি সুন্দরী যুবতী নারীর কথা বলা আছে, একইভাবে বেহেস্তে গেলমান বা শিশু-কিশোর প্রমোদ বালকদের কথাও বলা আছে। ১৪০০ বছর আগে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও আরবের সাহিত্যে বা কবিতায় এই ধরণের অনেককিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায়। একইভাবে, কোরআনেও জান্নাত বা বিশ্বাসীদের অনন্ত যৌনাচার আর ভোগবিলাসের স্থানে এই নেয়ামতগুলোর বর্ণনায় তিন জায়গাতে গেলমানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে 

১. তাদের কাছে ঘোরাফেরা করবে চির কিশোরেরা।

পানপাত্র কুঁজা ও খাঁটি সূরাপূর্ণ পেয়ালা হাতে নিয়ে।

–সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ১৭–১৮। 

২. সুরক্ষিত মোতিসদৃশ কিশোররা তাদের সেবায় ঘুরাফেরা করবে।

– সূরা তুর, আয়াত: ২৪।

৩. তাদের কাছে ঘোরাফেরা করবে চির কিশোরগণ।  আপনি তাদেরকে দেখে মনে করবেন যেন বিক্ষিপ্ত মনি-মুক্তা।

–সূরা দাহর, আয়াত: ১৯।

অনেক ইসলামিস্টই বলার চেষ্টা করবেন যে, ঐ সকল গেলমান বা প্রমোদ বালকদের সাথে যৌনকর্মের কথা কোরআন হাদিসে বলা নেই। কিন্তু সুন্দরী গোলাকার স্তনের হুর এবং মুক্তার মত সুন্দর চির কিশোর বালক কী কাজে লাগে, সেগুলোর ইঙ্গিত তো পরিষ্কার। যেখানে জান্নাত হচ্ছে অনন্ত ভোগ বিলাস আর আরাম আয়েশের জায়গা।  ইসলামে জান্নাতের বিবরণ থেকে আমরা সকলেই কমবেশি জানি, বেহেশতে জান্নাতিগণ যা খেতে চাইবেন সেইসবই চলে আসবে। সেখানে জান্নাতিদের পেশাব পায়খানার কোন বালাই থাকবে না। সবকিছুই থাকবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।  নগরায়ন, পয়নিষ্কাশন, সরকারী অফিস, থানা-পুলিশ ইত্যাদি সেখানে অপ্রয়োজনীয়।  খাবার রান্না করা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, বাজারসদাই করা, চাকরি বাকরি করে অর্থ উপার্জন, এই সবকিছুই সেখানে অর্থহীন। সবকিছুরই যথেষ্ট মজুদ থাকবে এবং চাওয়ামাত্রই সব হাজির হবে।  এরকম অবস্থায়, মনিমুক্তোর মত সুন্দর শিশু সেবক বা গেলমান বা প্রমোদ বালকদের কাজ কী হবে?

আফগানে 'বাচা বাজি'

ব্রিটিশ আমলে জমিদারী প্রথায় এই ভূখন্ডে অমানবিকতার এমন চিত্র নৈমিত্তিক হলেও কালের পরিক্রমায় এখন তা চিন্তার অতীত। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘বাচা বাজি’ নামে এখনও বহুলভাবে প্রচলিত তা।

সেখানকার প্রচলিত প্রবাদ, ‘শিশুপালনের জন্য নারী আর মনোরঞ্জনের জন্য বালক’ এর বহুল বিস্তারের প্রমাণ। আর ইসলাম বিরোধী এই প্রথা ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে তালেবান প্রভাব বিস্তারে।

সম্প্রতি কয়েকটি আফগান পরিবারের সাথে কথা বলে সংবাদ সংস্থা এএফপি, যাদের শিশুদের, মূলত বালকদের যৌন নির্যাতনমূলক ‘বাচা বাজি’র জন্য অপহরণ করা হয়। মানবাধিকারের জঘন্যতম লঙ্ঘন। এই শত বছরের পুরাতন প্রথাকে তালেবান জঙ্গিরা ব্যবহার করেছিলো অস্থিতিশীলতা বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। চরম অস্থিতিশীল উত্তরাঞ্চলকে অশান্ত রাখতে জঙ্গিদের এই সহায়ক বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আনে এএফপি।

হিন্দুস্তান টাইমসে সম্প্রতি ‘বাচা বাজি’র বিস্তার, বালক মনে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় এর নেতিবাচক প্রভাব বিষয়ক এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

বাচা বাজি কি?

ক্ষমতাশালী জমিদার, কমান্ডার, রাজনীতিবিদ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকেরা কর্তৃত্ব ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে প্রায়ই ‘বাচাদের’ (বালক) নিজেদের কাছে রাখে। তাদের মেয়েদের পোশাক পড়িয়ে রাখা হয়, পার্টিতে নর্তকী হিসেবেও দেখা যায় তাদের। প্রায় সময়ই তারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। তবে ইসলামবিরোধী এই নির্মমতাকে সমকামীতা হিসেবে গণ্য না করে, বরং সংস্কৃতি চর্চা হিসেবেই দেখা হয়।

কতটা প্রচলিত?

আফগানিস্তানের অনেক অংশে প্রচলিত প্রবাদই -‘শিশুপালনের জন্য নারী আর মনোরঞ্জনের জন্য বালক’ এর বিস্তৃতির প্রমাণ। প্রাচীন এই প্রথা ১৯৯৬-২০০১ সালের তালেবান শাসনের সময় নিষিদ্ধ করা। আফগানিস্তানের দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চলের শহুরে পশতুনদের মাঝে এবং উত্তরাংশে তাজিক জাতিসত্তার মাঝে এই প্রথা বহুলভাবে প্রচলিত।

কেন তা এতটা বিস্তৃত?

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, আফগান সমাজে নারী-পুরুষদের মাঝে কঠোর বিভাজন এবং নারী সঙ্গ না পাওয়া বাচা বাজির প্রসার ঘটিয়েছে। এছাড়াও আইনের শাসন না থাকা, দুর্নীতি, বিচারহীনতা, অশিক্ষা, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা এবং সশস্ত্র দলের উপস্থিতি এই প্রথার বিস্তারে সহায়ক বলে আফগানিস্তানের স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থা (এআইএইচআরসি) ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।

এআইএইচআরসি’র মতে, আফগানিস্তানের ফৌজদারি আইন ধর্ষণ এবং সমকামীতাকে নিষিদ্ধ করলেও বাচা বাজি নিয়ে কোন স্পষ্ট বিধান নেই। “বাচা বাজি বিষয়ে আফগানিস্তানের আইনে শূণ্যতা ও দ্ব্যর্থকতা রয়েছে, এবং বিদ্যমান আইনে তা যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি।” 

এছাড়াও “নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে অনেক অপরাধীর যোগাযোগ রয়েছে এবং ক্ষমতার ব্যবহার ও ঘুষ দিয়ে তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়।” 

এই বালকরা কোথা থেকে আসে?

বাচারা সাধারণত ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে হয়। তাদের অধিকাংশেই অপহৃত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবার চরম দারিদ্রের কারণে তাদের বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।

এআইএইচআরসি’র প্রতিবেদনে বলে, প্রায় সময় ধর্ষণের শিকার হতে হয় বলে এই বালকেরা গুরুতর মানসিক পীড়ায় ভোগে। আক্রান্তরা মানসিক চাপ, অবিশ্বাস, হতাশাবোধে ভোগে। এই শিশুদের মন সবসময় আতঙ্কগ্রস্থ থাকে এবং তাদের মনে প্রতিশোধের স্পৃহা থাকে, তারা সবাইকে শত্রু ভাবে।

এর ফলে অনেক আক্রান্ত কিশোরও ‘বাচা’ রাখার মনোভাব নিয়েই বড় হয় এবং এই নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি অক্ষুণ্ন রাখে। লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চাথাম হাউজের বিশেষজ্ঞ চারু লতা হগ বলেন, এই ধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া বালকদের পুনরুদ্ধার এবং পুনর্বাসনের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় তাদের পরবর্তী জীবন কেমন হয় তা জানা সম্ভব হয় না। নিজেদের জন্য বাচা রাখার অভিপ্রায় নিয়েই অনেকে বড় হয়, যা বর্বরতার চাকা সচল রাখে।

Read in English:

Ghetuputra Kamala movie, Gelman's story and 'Bacha Baji' in Afghan


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন